September 23, 2023, 5:01 pm
একুশে বইমেলা, ২০১৯ উপলক্ষে পরিবার পাবলিকেশন্স প্রকাশ করেছে কবি সোহাগ সিদ্দিকীর (জন্ম-১৯৬৩) প্রথম ছড়াগ্রন্থ ‘টকার’। মূলত তিনি একজন কবি। ২০১৮ সালে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’ ‘অপূর্ণতায় পূর্ণ’। একজন সাহিত্য সম্পাদক হিশেবেও তিনি ভূমিকা পালন করেছেন : ’আরশিনগরের পড়শি’ ও ’অনুবাক’ তাঁর সম্পাদিত সাহিত্যের কাগজ। এ ছাড়া তাঁর যৌথ সম্পাদনায় ‘শত প্রেমের কবিতা’ নামে একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা ইতঃপূর্বে তাঁর ‘অপূর্ণতায় পূর্ণ’ কাব্যে একজন জীবনবাদী কবিকে দেখেছিলাম। আত্মদর্শন, হিতকথন কিংবা ইতিবাচক জীবনবোধের প্রকাশে কাব্যটি ঋদ্ধ ছিল। তিনি এ কাব্যে স্বদেশ, পৃথিবী, মানুষ, প্রকৃতি, প্রেম, স্বাধীনতা সহ নানা বিষয়ে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। আর কাব্যটির সবগুলো কবিতাই ছিল ছন্দোবদ্ধ ও শ্রুতিনন্দন। আলোচ্য ‘টকার’ ছড়াগ্রন্থের বৈষয়িক চেতনাটি প্রায় একইভাবে প্রবহমান থেকেছে, যদিও ছড়ার বৈশিষ্ট্য মেনেই তাঁর ভাষা কবিতার মতো গূঢ়ার্থ প্রকাশ না করে সরাসরি ও সহজতর বক্তব্য তুলে ধরেছে। আসলে ছড়া তো আর কবিতা নয়। এর সরল ও ছন্দোস্পন্দময় ভাষা কবিতার মতো পাঠককে ভাবায় না, তার মনে সাধারণত গভীর ভাব বা নান্দনিকতার আবেশ ছড়ায় না।
ছড়া পাঠককে তার পরিচিত জীবন, সমাজ, পরিপার্শ্ব ও পৃথিবী সম্পর্কে মনে করিয়ে দেয়, সহজ ভাষায় ছন্দিত আকারে সরাসরি তথ্য ও বক্তব্য পরিবেশন করে। সেই নিরিখে সোহাগ সিদ্দিকীর ছড়াগ্রন্থটিতে সংকলিত ছড়াগুলো মানোত্তীর্ণ বলেই ধরে নেয়া যায়। ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে তাঁর মোট একচল্লিশটি ছড়া স্থান পেয়েছে। মোটা দাগে যে-সব বিষয় এই গ্রন্থের উপজীব্য হয়েছে সেগুলো হলো— বঙ্গবন্ধু ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও গৌরব, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও নিসর্গপ্রেম, মরমী চেতনা, প্রেম ও বন্ধুত্বের জয়গান, মে-দিবস ও খেটে-খাওয়া দুঃখী মানুষদের কথা, ছা-পোষা চাকুরের দুর্বিষহ জীবন, বর্ণাঢ্য জীবনে ভালোবাসার অভাববোধ, বিভিন্ন মানবিক সমস্যা, দুর্ভোগ ও সঙ্কট, টকশোতে অংশ-নেয়া এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর চরিত্র, স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখোস উন্মোচন, বর্বরতা, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ প্রভৃতি অপরাধের বিরুদ্ধাচরণ ইত্যাদি।
অল্প কিছু উদাহরণ দেয়া যাক— ১. ‘ভোরের ছবি’ ও ‘পিতা তোমার মুখ আমার বাংলাদেশ”— এ দুটি ছড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছড়াকারের পরম শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। যেমন— ( বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে) “প্রকৃতিতে সুখের জোয়ার কে আর থাকে বসে জন্ম নিল শ্রেষ্ঠ শিশু মার্চ সপ্ত দশে” ”লাল সবুজের পাতায় পাতায় ইতিহাস বহমান, স্বাধীন জাতির স্বাধীন পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ২. শ্রমজীবী মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা এভাবে প্রকাশ পেয়েছে— ”তুমি যখন পাথর ভাঙো আমি ভাঙি শব্দ তোমার আমার পরিচয় শ্রমের দামে লব্ধ।” ৩. দেশের বিরুদ্ধে অপরাজনৈতিক ও বিধ্বংসী কার্যকলাপ তাঁর ভাষায় এভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে— ”অধর্ম আজ ধর্ম হয়ে খাচ্ছে মানুষ গিলে মানচিত্রে চাপাতির কোপ চমকে ওঠে পিলে। ৪. নিসর্গের প্রতিবেশ ও জীবের অস্তিত্ব রক্ষার কামনা— ”পাহাড় নদী গাছগাছালি ছবির মতো এমন থাক, এই পৃথিবীর তাবৎ প্রাণী মুক্ত-স্বাধীন জীবন পাক।” ৫. জগতের প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রতি তাঁর নিরন্তর শুভেচ্ছা এভাবে প্রকাশ পেয়েছে— ”ওরা দুজন জোড়া শালিক জনম জনম জোড়া ওদের জন্য এক পৃথিবী গোলাপ ফুলের তোড়া।” ৬. তাঁর মরমী চেতনার প্রকাশ— ”বৃথাই হবে ভজন সাধন ডুবে গেলে বেলা মিলবে না তো আগের মতো মন মানুষের মেলা।” সোহাগ সিদ্দিকী দেশ, জীবন ও সমাজকে যেমন দেখেছেন ও ভেবেছেন, তেমনই লিখেছেন। তিনি বেশ স্পষ্টবাদী, তাঁর অনুভূতিগুলো সরল। নিগূঢ় বক্তব্য উপস্থাপনের দ্বারা নিছক কাব্যিকতা তাঁর আরাধ্য নয়। তাঁর ছড়ায় পাণ্ডিত্যের বাগাড়ম্বরতা নেই, শব্দের ঝকমারি বা আত্মপ্রদর্শনের স্পৃহা নেই, বরং সেখানে সরল ও সাবলীল ভাষায় মানবিকতা, দেশপ্রেম ও ইতিবাচক জীবনবোধের নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনাই লক্ষ্য করা যায়। আমি গ্রন্থটির পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি। গ্রন্থ পরিচয় : ‘টকার’, লেখক : সোহাগ সিদ্দিকী, প্রকাশক : পরিবার পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রচ্ছদশিল্পী : চারু পিন্টু, মূল্য : আশি টাকা।
Leave a Reply