March 28, 2024, 10:22 am
ডেস্ক নিউজ: মালয়েশিয়ার অভিবাসী বন্দিশিবিরে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতনের কথা আল জাজিরার সাক্ষাৎকারে তুলে ধরায় গ্রেফতার হয়েছেন রায়হান কবির। শুক্রবার (২৫ জুলাই) বিকালে তাকে কুয়ালালামপুরের সেতাপাক এলাকা থেকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। এর আগে, তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হয়। সত্যি কথা বলায় রায়হানের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কয়েকজন আইনজীবী। তবে বাংলাদেশ এখনও তার বিষয়ে নীরব!
মালয়েশিয়ার কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষের গোয়েন্দা ইউনিট গোপন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রায়হানকে শুক্রবার বিকালে গ্রেফতার করে। রায়হানের সঙ্গে তাকে আশ্রয়দানকারী ব্যক্তিকেও আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। বিকালে আটকের পর সন্ধ্যায় মালয়েশিয়া পুলিশের কাছে রায়হানকে হস্তান্তর করা হয়। ইমিগ্রেশন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, রায়হানকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে এবং সে আর কোনোদিন মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ পাবে না।
তবে সূত্রটি নিশ্চিত করে বলেছে, এখনই তাকে দেশে পাঠাবে না ইমিগ্রেশন বিভাগ। পুলিশ তাকে আদালতে তুলে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করবে বলে জানা গেছে। রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এমনকি সে দেশে তার জেল জরিমানাও হতে পারে।
আরও জানা যায়, মালয়েশিয়ায় রায়হানকে দু’জন আইনজীবী আইনি সহায়তা দেবেন। তারা সোমবার দুপুরে বুকিত আমানে পুলিশ সদর দফতরে রায়হানের সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছেন। আইনি সহায়তা প্রাপ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান।
এদিকে রায়হানের গ্রেফতারে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিবাসন খাতের ২১ সংগঠন। তারা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম, এই ঘটনার পর সাংবাদিকদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো মালয়েশিয়া। আল জাজিরার প্রতিবেদনে কথা বলার কারণে বাংলাদেশি তরুণ মো. রায়হান কবিরের (২৫) ব্যক্তিগত তথ্য চেয়ে সমন জারি ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রশাসন। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, গণমাধ্যমে কথা বলা কোনও অন্যায় নয়। আর রায়হান কোনও অপরাধও করেননি। অথচ এমনভাবে মালয়েশিয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে খুঁজছে, যেন সে বড় অপরাধী। এর মধ্যেই শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় মালয়েশিয়ার পুলিশ। আমরা রায়হানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
রায়হান কবিরের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তার বাবা আশরাফুল আলম একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। রায়হান ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আসছেন। কিন্তু নিজে কোনোদিন কোনও অন্যায় করেনি বলে জানান তার বাবা। ২০১৪ সালে সরকারি তোলারাম কলেজে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মালয়েশিয়া চলে যান রায়হান। সেখানেই বিএ পাস করেন।
রায়হান গ্রেফতারের দুই দিন আগে তার বাবাকে জানিয়েছিলেন তিনি সে দেশে কোনও অপরাধ করেননি। যা করেছেন দেশের জন্য করেছেন, দেশের মানুষের জন্য করেছেন। শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গ্রেফতারের দুই দিন আগে আমার ছেলের সঙ্গে কথা হয়, তাও ভয়েস মেসেজ পাঠায় রায়হান। সে বলেছে, সে কোনও অপরাধ করেনি। আমিও জানি আমার ছেলে কোনও অপরাধ করতে পারে না। সে যা করেছে দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য করেছে। আমি চাই পুরো দেশ তার পাশে থাকুক। তিনি আরও বলেন, রায়হানকে গ্রেফতারের পর একজন আমাকে ছবি পাঠিয়ে বিষয়টি জানায়। আমার ছেলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গ্রেফতার হয়েছে, সে সত্য বলেছে।
এদিকে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই কিন্তু অনেক বাংলাদেশি মালয়েশিয়া থেকে ফেরত এসেছে। এদের অনেকেই কিন্তু নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে এবং নির্যাতনের কোনও মাত্রা নাই। এসব নির্যাতনের ঘটনার একটি প্রতিফলন কিন্তু আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখা গেছে। কিন্তু আমরা কখনও দেখিনি যে এই ধরনের ঘটনায় আমাদের রাষ্ট্র শক্ত কোনও প্রতিবাদ করেছে। যেসব ভুক্তভোগীর কথা সামনে আসছে, আমাদের রাষ্ট্রদূত কিংবা দূতাবাসের কর্মকর্তারা কি কখনও জানতে চেয়েছে কেন উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বারবার আমরা কয়েক লাখ কর্মীর শ্রম বাজারের কথা চিন্তা করে কিছু বলি না। এগুলো ভাবতে গিয়ে আমরা সবসময় কর্মী নিপীড়নের কথা এড়িয়ে যাই। শুধু বাংলাদেশ না, কোনও দেশের ঘটনাতে আমরা শক্তভাবে কিছু বলতে পারি না। একটি ছেলে সাক্ষাৎকার দেওয়ায় পুরো বাংলাদেশ কমিউনিটিকে যেভাবে হেয় করা হচ্ছে, ওয়ার্কপারমিট বাতিল করা হচ্ছে, এগুলো কিন্তু কোনও আইনের মধ্যেই পড়ে না। এই একই ইন্টারভিউতে আরও অন্য দেশের নাগরিকদের বক্তব্যও আছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে এরকম করতে পারে, কারণ তারা জানে যে এরকম করলে কেউ কোনও প্রতিবাদ করবে না। আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশ চাইলে মালয়েশিয়ার কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারতো বা জানতে চাইতে পারতো বা মালয়েশিয়া ঘটনা তদন্ত করতে পারতো। তা না করে অভিবাসীদের যে মর্যাদার আইন সেটা তারা ভেঙেছে। রায়হানের পাশে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের সংগঠন, ১৯৯০-এর কনভেনশনে যারা স্বাক্ষর করেছে তাদের সবারই থাকা উচিত।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, রায়হানের সঙ্গে যা হয়েছে তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির অ্যাডভাইজর নূর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশ থেকে মানুষ গিয়ে অন্য দেশে কাজ করছে। সে দেশের উন্নয়নে সাহায্য করছে। যিনি কাজ করছেন আর্থিক সুবিধার জন্য তিনি ওই দেশে যাচ্ছেন। সেখানে কেউ নিবন্ধিত কেউ অনিবন্ধিত। রাষ্ট্র যখন কোনও অনিয়মের আশ্রয় নেয়, সেটি নিয়ে মিডিয়ায় যখন কথা বলে, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে একটা মানুষকে একটা রাষ্ট্র যখন হয়রানি করে, সে যে দেশেরই হোক, তখন এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
তিনি আরও বলেন, রায়হানকে যেভাবে আটক করা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দমন-পীড়নের মতো একটি ভয়ার্ত পরিবেশ মালয়েশিয়া সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে অভিবাসী শ্রমিকরা নিপীড়ন-নির্যাতন নিয়ে কোনও কথা না বলে। মানবাধিকার ইস্যুর পাশাপাশি এখানে আমাদের রাষ্ট্রকেও সোচ্চার হতে হবে। সে একজন বাংলাদেশের নাগরিক এবং প্রবাসীদের আয় দিয়েই কিন্তু আমাদের উন্নয়নের চাকা ঘুরে। রায়হানের বিষয়ে নীরব মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন। সেখানের কেউই এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউই এই বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানিয়েছেন, তিনি রায়হানের বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে আলোচনা করবেন। তিনি বলেন, এই ধরনের ইস্যুগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও ভালোভাবে দেখভাল করতে পারে। তারাই দেখেন এসব বিষয়। তারা বিষয়টি সে দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারে। আগামী সপ্তাহে আমাদের একটি মিটিং হবে, আমি সেখানে প্রসঙ্গটি তুলবো, দেখা যাক কী করা যায়। মন্ত্রী আরও বলেন, যে দেশে যেমন আইন, সে দেশে সেভাবে আচরণ থাকা উচিত। বাংলাদেশে যা করা যাবে, বিদেশে তা নাও করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ৩ জুলাই লকডআপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট-শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আল-জাজিরা। এতে দেখানো হয়, মালয়েশিয়া সরকার মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার (এমসিও)-এর মাধ্যমে মহামারির সময়ে অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। সেখানে রায়হান কবিরের একটি ইন্টারভিউ প্রদর্শিত হলে সে দেশের অভিবাসন বিভাগ তাকে খুঁজতে থাকে। তার ছবি প্রকাশ করে তারা রায়হানের বিষয়ে তথ্য জানানোর অনুরোধ করে। এছাড়া প্রতিবেদনের সঙ্গে আল জাজিরার সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
Leave a Reply